এদিকে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর ‘সামরিক অভিযানে’ ১৯৬ ত্রাণকর্মী নিহত হওয়ার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে জাতিসংঘ। শুক্রবার এই দাবি জানান জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সোমবার গাজার দেইর আল বালাহতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক খাদ্য সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের (ডব্লিউসিকে) গাড়িতে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এতে ৭ ত্রাণকর্মী নিহত হন। তাদের মধ্যে একজন অস্ট্রেলিয়ার, তিন জন যুক্তরাজ্যের, একজন যুক্তরাষ্ট্রের, একজন পোল্যান্ডের ও একজন ফিলিস্তিনের নাগরিক। ইসরায়েল প্রথমে এ ঘটনার দায় সুকৌশলে এড়াতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপে দখলদার নেতানিয়াহু প্রশাসন দায় স্বীকার করতে বাধ্য হয় ও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়। এমনকি এ ঘটনায় দায়ী দুই সেনা কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করে ইসরায়েলি প্রশাসন।
শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ইসরায়েল তাদের ভুল স্বীকার করেছে। এটা ইতিবাচক হলেও ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধকৌশল ও পদ্ধতির কারণে গাজায় এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ১৯৬ জন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। আমরা প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। আমরা জানতে চাই, কেন ত্রাণকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে।
এছাড়া, গাজায় হামলার পাশাপাশি সেখানে ত্রাণ সরবরাহেও বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। ফলে অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় বসবাসরত ২২ লাখ ফিলিস্তিনি ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়েছে। খাবার-পানির অভাবে উপত্যকাটিতে মানুষের মৃত্যুও শুরু হয়েছে। এ ইস্যুতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, যখন সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তখন ক্ষুধার জ্বালা শুরু হয়। বর্তমানে গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ভয়াবহ ক্ষুধার মুখোমুখি। এমনকি, খাদ্য ও পানির অভাবে শিশুরা মারা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি সহ্য করার মতো নয় এবং চাইলেই এটি এড়ানো সম্ভব। এজন্য ইসরায়েলকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার খান ইউনিস থেকে এক জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে ইসরায়েলি সেনারা। ইলাদ কাতজির নামের এই ইসরায়েলিকে গত ৭ অক্টোবর গাজায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি অবৈধ দখলদার ইসরায়েলের নির ওজ নামের একটি এলাকায় থাকতেন। শনিবার মধ্যরাতে খান ইউনিসে অভিযান চালিয়ে ইলাদ কাতজিরের মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার পরিচয় শনাক্ত করা হয় এবং পরিবারকে এ ব্যাপারে অবহিত করা হয়।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, অপহৃত ইলাদ কাতজিরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে জানা গেছে তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদের কাছে জিম্মি থাকা অবস্থায় হত্যার শিকার হন। পরে তাকে উদ্ধার করা হয় এবং ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা হয়। ৪৭ বছর বয়সী কাতজিরের সঙ্গে তার ৭৭ বছর বয়সী মা হান্নাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে গত নভেম্বরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে এক সপ্তাহব্যাপী যে যুদ্ধবিরতি চলে ওই সময় কাতজিরের মাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গত ৭ অক্টোবরের হামলায় এই ব্যক্তির বাবা প্রাণ হারান। গত জানুয়ারিতে কাতজিরের একটি ভিডিও প্রকাশ করে ইসলামিক জিহাদ। ওই ভিডিওতে তাকে কথা বলতে দেখা যায়। তিনি বলেন, তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং তাকে ও অন্য জিম্মিদের উদ্ধারের আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, তিনি পরিবারের সদস্য ও প্রিয়জনদের খুব মিস করছেন।
এদিকে শনিবার ফজরের নামাজের সময় উত্তেজনা সৃষ্টি ও হামাসপন্থি স্লোগান দেওয়ায় ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে ইসরায়েলি পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, আঁতশবাজি ছোঁড়ার জন্য একজনকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদের ধরা হয়েছে হামাসের সমর্থনে স্লোগান দেওয়ায়। ঘটনার এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে ড্রোনের মাধ্যমে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। পবিত্র রমজানের শেষ দিকে লাইলাতুল কদরের রাতে সেখানে জড়ো হয়েছিল মুসল্লিরা। গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আল-আকসায় প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করে ইসরায়েল। যেসব শিশুর বয়স ১০ বছরের নিচে, যেসব নারীর বয়স ৫০ বছরের ওপরে ও ৫৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশের অনুমোদন দেওয়া হয়।
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার পর অভিযান শুরু করে ইসরায়েল, যা এখনো চলছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় গত প্রায় ছয় মাসে এক লাখের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছেন। হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। জানা গেছে, ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৩৩ হাজার ৯১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৫ হাজার ৭৫০ জন। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল গত কয়েক মাস ধরে গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে; কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তাতে কর্ণপাত করছেন। নেতানিয়াহু জানিয়ে দিয়েছেন, হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তাদের হামলা চলতেই থাকবে।